সিলটের ঐতিহ্যবাহী সাতকড়ার স্বাদ কি পরখ করেছেন?
সিলেটসহ মৌলভীবাজারের সাত উপজেলাবাসীর কাছে খাদ্য তালিকায় বাড়তি চাহিদার নাম ‘সাতকরা’। সিলেট অঞ্চলে রান্নাঘরে সাতকড়ার ব্যাপক কদর আছে। এখানকার প্রতিদিনের রান্নায়, বিশেষ করে মাংস জাতীয় তরকারি রান্নায় ‘সাতকরা’ যেনো অপরিহার্য। এটি ছাড়া অধিকাংশ খাদ্যবিলাসী মানুষের রসনা বিলাসই যেনো অসম্পূর্ণ। গৃহিনীরা মাছ ও মাংসের তরকারিতে স্বাদ বাড়াতে ‘সাতকরা’ ব্যবহার করে। পরিমাণ মতো সাতকরা দিলে স্বাদ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তবে পরিমাণ অতিরিক্ত হলে উল্টো ফল হতে পারে। মাংসের সঙ্গে রান্না করলে একটি আকর্ষণীয় ঘ্রাণযুক্ত খাদ্য তৈরি হয়। এটি ওই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী রান্না। সিলেটে অতিথি আপ্যায়নে সাতকরার সুনাম আছে। শৌখিন পরিবারের সদস্যদের জিবে জল আনে এই সাতকরা।
এখন সিলেট নগরীর বেশিরভাগ রেস্টুরেন্ট আর রেস্তোরায় তরকারির মধ্যে সাতকরা দেওয়া হয়। স্থানীয় অনেকেই সাতকরা দিয়ে নানা রকম আচার তৈরি করছেন। যা সাতকড়ার স্বাদ বাড়িয়ে তুলেছে।
সাতকরা বা সাতকড়ার (বৈজ্ঞানিক নাম: Citrus macroptera) হল Rutaceae পরিবারের সাইট্রাস গণের অন্তর্ভুক্ত লেবু জাতীয় ফলের গাছ।এটি সিলেট, মালেসিয়া এবং মেলানেশিয়ার একটি স্থানীয় ফল।সাতকরা বিশেষ ঘ্রাণযুক্ত লেবু জাতীয় এক প্রকার টক ফল, যা সব্জির আনুষঙ্গিক হিসেবে রান্নায় ব্যবহৃত হয়। সাইট্রাস গোত্রের অন্তর্ভুক্ত লেবুজাতীয় একটি ফল। লেবুগাছের মতো সাতকরার কাঁটাভরা গাছ ২০ থেকে ২৫ ফুট লম্বা হয়। ফাল্গুন মাসে ফুল আসে। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে ফল হয়। সিলেটে এর প্রচুর চাহিদার কারণে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আসাম ও মেঘালয় থেকেও সাতকরা আমদানি হয়। এই ফল ভারতের আসামের পাহাড়ি এলাকার আদি ফল, যা বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাটের জাফলং ছাড়াও এখানকার পাহাড়-টিলায় চাষ হয়।
অন্যান্য টক জাতীয় ফলের মতো সাতকরায় প্রচুর ভিটামিন সি বিদ্যমান। এটি বমিনাশক, খাবারের রুচি বাড়ায় ও হজমে সহায়তা করে। এর প্রাকৃতির ফ্লেভার বা সুগন্ধি বেশ আকর্ষণীয়। এর মধ্যে ২৫টি উপাদান আছে।
সাতকরা যে শুধু সুস্বাদু তরকারি ও টক তা নয়। এ ফলটি জনস্বাস্থ্যের জন্যও অনেক উপকারী। বাত, শিরা-উপশিরা ব্যথায় যারা ভুগছেন তারা ‘সাতকড়া’ খেলে এসব রোগ থেকে উপশম পেতে পারেন। ক্যান্সার, কলন ক্যান্সার এসব প্রতিরোধে সাতকরা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এটি ফাইবার জাতীয় খাদ্যের উৎস। কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে অত্যন্ত কার্যকর । গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য একটি সাধারণ সমস্যা , এই সময়ে এই সবজিটি উপকারী। সাতকড়া রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়। যারা নিয়মিত এই ফল খান তাদের লিভার, কিডনি এবং হার্ট রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে বলে আশা করা যায়।
সুগন্ধি তৈরিতে সাতকরার ব্যবহার রয়েছে। এর পারিফিউম গুণাবলী চমৎকার ও এটি খুবই প্রাকৃতিক। অন্য পারফিউমের মতো কৃত্রিম নয়। দেশের চাহিদা পূরণ না হলেও সাতকরা বহু আগে থেকেই বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে পারফিউমারি ইন্ডাস্ট্রির কাঁচামাল হিসাবে। এটি থেকে যে তেল তৈরি করা হয় তা দিয়ে অতি উচ্চ মূল্যের সুগন্ধি দ্রব্য তৈরি করা হয় ।
এটি সুগন্ধি হিসেবে কাজ করে। যেমন-একটি ডিপ ফ্রিজে সবুজ একটি সাতকরা একসপ্তাহ রেখে তারপর খোলা হলে পুরো কক্ষ সুগন্ধিতে ভরে যাবে। এটা যে কেউ বাসা বাড়িতে প্রয়োগ করে দেখতে পারেন।
সাতকরায় এসেনশিয়াল ওয়েল বা সুগন্ধি তেল থাকে খোসার ওপর। যা সাতকরা হাতে নিলে দেখা যায়। তবে সাতকরায় অন্য সব সাইট্রাস ফলের মতো ভেতরের রসালো অংশ খাওয়া যায় না। কারণে এতে প্রচুর পরিমাণে এসিডিক ও তেতো স্বাদ থাকে।
এখন জেনে নিন কিভাবে সাতকরা সংরক্ষণ করে রাখবেন। রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে পারেন।
রোধে শুকিয়ে রাখার পদ্ধতি
সাতকরা লম্বালম্বিভাবে একটি পুরু রেখে (একটি সাতকরা ১২/১৪ টুকরা) কেটে বেশ কদিন রোদে শুকিয়ে পলিথিনে মোড়ে একটি পাত্রে রেখে দিন। যখন খাওয়া প্রয়োজন রান্নার ১ ঘণ্টা আগে পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। একদম স্বাভাবিক সাতকরার স্বাদ ও গন্ধ পাওয়া যাবে। আর তা রান্না করতে পারবেন কাঁচা সাতকরার নিয়মেই।
ভাপ দিয়ে ফ্রিজে সংরক্ষণ
সবচেয়ে সহজ আর উপযুক্ত পদ্ধতি হচ্ছে ভাপ দেওয়া পদ্ধতি। সাতকরা কেটে রসালো লেবুর অংশ ফেলে দিয়ে ১২-১৪ টুকরা করে শুধু পানিতে ৮-১০ মিনিট জাল দিয়ে পানি ঝরিয়ে নিন। ঠাণ্ডা হলে যেকোনো একটি পাত্রে ডিপ ফ্রিজে রেখে দিন।
এমনভাবে সাজিয়ে রাখবেন যেন প্রয়োজন হলে এক টুকরাও নিতে পারেন। একই নিয়মে কয়েক মাস রাখলেও সাতকরার স্বাদ-গন্ধ অটুট থাকে। এতে একদম কাঁচা সাতকরা রান্নার স্বাদই পাওয়া যায়।