সুস্থ-সবলভাবে বেঁচে থাকতে পুষ্টিকর খাবার খেতেই হবে। এর চাহিদা পূরণে শাকসবজির অবদান অনন্য। শাকসবজিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থসহ অন্যান্য অনেক পুষ্টি উপাদান। সে সাথে আঁশে ভরপুর। এসব পুষ্টি উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, খাবারে রুচি আনে। এ ছাড়া হজমশক্তি বৃদ্ধিতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে যথেষ্ট সহায়তা করে। পুষ্টিবিদদের মতে, একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের দৈনিক ২০০ গ্রাম শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমরা খাই মাত্র ৬০-৭০ গ্রাম। তাও আলুসহ। । রবি বা শীত মৌসুমে অধিকাংশ সবজি চাষের উপযোগী হওয়ায় মোট উৎপাদনের প্রায় ৬০% সবজি এ মৌসুমে হয়। শাকসবজি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। বাংলাদেশের শাকসবজির পুষ্টিমানের তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি বিভিন্ন পুষ্টি সরবরাহ করে। তাই পারিবারিক পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরাপদ শাকসবজি আবাদের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের শাকসবজি নির্ভর নিরাপদ খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক চাহিদানুযায়ী শাকসবজি গ্রহণের ফলে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনী রোগ, ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়। শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে আঁশও থাকে, যা মলাশয়ের ক্যান্সার, মূত্রনালীর পাথর, ডায়াবেটিস, স্থুলকায়ত্ব, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি রোগপ্রতিরোধ করতে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে দেহকে সুস্থ ও সতেজ রাখে। এছাড়াও শাকসবজিতে বিদ্যমান আঁশগ্রহণকৃত খাদ্য দ্রবের মধ্যস্থিত অতিরিক্ত কোলেস্টেরল/চর্বিসহ অনেক ক্ষতিকর রাসায়নিকের সাথে যৌগ তৈরি করে শরীর থেকে নিষ্কাশন করার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। শাকসবজিতে বিদ্যমান ভিটামিন ই, সি এবং বিটাক্যারোটিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার যেমন-প্রস্টেট, ওভারিয়ান, স্তন এবং বিশেষ করে ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
উদ্ভিদ কোষের প্রাচীর সেলুলোজ দিয়ে তৈরি। এর ফলে কোষ প্রাচীর কঠিন ও অস্থিতিস্থাপক হয়। প্রাচীরে হেমিসেলুলোজও থাকে। প্রাচীরের নিচে পেকটিন জাতীয় শর্করা থাকে যা আঠার মতো কাজ করে এবং সবজির খোসাকে ভেতরের অংশে আটকে রাখে। সবজি পরিপক্ব হলে পেকটিন দ্রবীভূত হয় এবং খোসা ঢিলে হয়ে পড়ে।প্রাচীরের ভেতর Protoplasmic Membrane থাকে যা Protoplasm-কে ধরে রাখে। এতে Plastids ও থাকে, যাতে ওই শাকসবজির রঞ্জক পদার্থ অবস্থান করে। এগুলো হচ্ছে কোরোপ্লাস্টস- এতে সবুজ রঞ্জক পদার্থ কোরোফিল থাকে। পাতায় এই পদার্থ বেশি থাকে। ক্রোমোপ্লাস্টস- এতে পানিতে অদ্রবণীয় হলুদ, কমলা বর্ণের ক্যারোটিন থাকে যেমন- মিষ্টিকুমড়া, গাজর ইত্যাদি। লিউকোপ্লাস্টস-বর্ণহীন, এতে এ্যানথোসায়ানিন ও ফ্লেভোনস জাতীয় বর্ণহীন উপাদান থাকে যেমন আলু, শালগম, মুলা ইত্যাদি। এ্যানথোসায়ানিন অবশ্য লাল, বেগুনি রঞ্জক পদার্থের উপাদান, যেমন-বীট, লালশাক, বাধাঁকপি ইত্যাদিতে থাকে। কোষের ভেতর বেশির ভাগ জায়গাজুড়ে Vacuoles থাকে যাতে সেলুলোজ, কিছু প্রোটিন ও চর্বির মিশ্রণ থাকে। বেশির ভাগ শাকসবজিতে পানির পরিমাণ বেশি (>৮০ শতাংশ) এবং প্রোটিন ২-৩ শতাংশ। বিচি, শিম-এ প্রেটিন বেশি থাকে। কন্দ ও মূলজাতীয় সবজিতে শ্বেতসার প্রচুর থাকে। ডাঁটা, পাতায়, সবজির খোসায় সেলুলোজ, হেমিসেলুলোজ, পেকটিন, গাম থাকে যা সবজির কাঠিন্য ও আকার ঠিক রাখে। এছাড়াও কিছু এনজাইম ও inhibitors থাকে।
মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ লোক, বিশেষ করে মেয়েরা লৌহের অভাবে রক্তস্বল্পতার শিকার। একমাত্র ভিটামিন-এ’র অভাবে বছরে ৩০ হাজারেরও অধিক শিশু অন্ধ হয়ে যায়। চোখে কম দেখার সংখ্যা আরও বেশি। তবে সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টির ঘাটতি যতটুকু তার চেয়ে বড় বাধা পুষ্টির উৎস সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা এবং অসচেতনতা। যারা দিন আনে দিন খায় তারাই কেবল পুষ্টিতে ভোগে তা কিন্তু নয়। বিত্তশালী শিশুরাও আজকাল শাকসবজি না খেয়ে রাতকানায় ভুগছে; যে কারণে ওরা চোখে চশমা পরতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ হাতের কাছে পাওয়া কচুশাক, কলমিশাক, হেলেঞ্চা, সজিনাসহ নানারকম শাকসবজি অভাবী মানুষের পুষ্টি সরবরাহ করে। সেজন্য বিভিন্ন শাকসবজির পুষ্টি ও ভেষজগুণ সম্পর্কে জেনে নেয়া দরকার। বিভিন্ন প্রকার ফল সবজিতে শ্বেতসার, ভিটামিন ও খনিজলবণ থাকে। রঙিনসবজি, যেমন- গাজর, মিষ্টিকুমড়া, টমেটো প্রভৃতিতে উল্লেখযোগ্য পরিমান ক্যারোটিন থাকে। কাঁচামরিচ, টমেটো, বাঁধাকপি, ভিটামিন-সি এর ভালো উৎস। সব সবজিতে ভালো পরিমাণ পটাশিয়াম থাকে। শাকসবজিতে পানির পরিমাণ বেশি বলে প্রোটিন ও শক্তিমূল্য কমে যায়। এজন্য লাউ, শশা, ঝিঙা প্রভৃতি সবজির ক্যালরি ও প্রোটিনের মান খুবই কম।
সবুজপাতায়, পালংশাকে, বিট, সবুজ বীজে oxalic acid থাকে। খনিজ উপাদানের মধ্যে K, Ca, Fe, Na ইত্যাদি থাকে লবণরূপে যেমন phosphates, chlorides, carbonates ইত্যাদি। Phenolic যৌগ hydroxyl acids, flavones সবজিতে থাকে। সালফারজাতীয় যৌগের জন্য সবজিতে বিশেষ ধরনের গন্ধ পাওয়া যায়। আলুতে 2-isopropyl-3-me thoxypyrazine, বাঁধাকপিতে dimethyl sulfide, পেঁয়াজে thriopropanal-s-oxide অথবা এদের মিশ্রিত যৌগ থাকে। পেঁয়াজ, বাঁধাকপি, মুলা, সরিষা প্রভৃতিতে উদ্বায়ী সালফার যৌগ থাকে যার গন্ধ রান্নার সময় ছড়িয়ে পড়ে। গ্লাইকোসাইড জাতীয় উপাদানের জন্য করলা, লেবুর খোসা তেতো লাগে। কলমিশাক গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত একটি শাকের নাম। এক ধরনের কলমির ডাঁটা লাল আর অন্যটির ডাঁটা দেখতে সাদা-সুবজ। এর প্রতি ১০০ গ্রাম (আহারোপযোগী) শাকে ১০৭৪০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন আছে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ১.৮ গ্রাম, শর্করা ৯.৪ গ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১০৭ মিলিগ্রাম, লৌহ ৩.৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.৫৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ৪২ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে ৪৬ কিলোক্যালরি। ভিটামিন-এ’র অভাবে আমাদের দেশে প্রতি বছর ৫ লাখ শিশু রাতকানায় আক্রান্ত হচ্ছে। একই কারণে প্রতিদিন গড়ে ১০০ এবং বছরে ৩০ হাজার শিশু একেবারেই অন্ধ হয়ে যায়। অথচ ক্যারোটিনসমৃদ্ধ অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি কলমিশাক খেলে এ জাতীয় রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। শিশুরা যেন পর্যাপ্ত বুকের দুধ পেতে পারে এজন্য মায়েদের কলমিশাক খাওয়া বাঞ্ছনীয়। বোলতা, ভিমরুল বা মৌমাছিতে কামড়ালে কিংবা শিং, ট্যাংরা মাছের কাটা ফুটলে কলমিশাকের পাতা ও ডাঁটা বেটে আক্রান্ত স্থানে প্রলেপ দিলে কিছুক্ষণ পরেই যন্ত্রণা কমে যায়।
উদ্ভিদের অন্যান্য অংশ হতে সবুজশাক পাতায় খাদ্য উপাদান বেশি থাকে। ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফলিকএসিড, ক্যারোটিন, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-কে প্রভৃতি ভালো পরিমাণ থাকে। গাঢ় সবুজ রঙের পাতায় এই সকল উপাদান হালকা সবুজপাতা হতে বেশি পরিমাণে থাকে। ভিটামিন-সি এর জন্য শাকপাতায় লৌহের শোষণ সম্ভব হয়। সবুজ, হলুদ, শাকসবজির প্রধান অবদান হচ্ছে ক্যারোটিন। ক্যারোটিন দেহে ভিটামিন ‘এ’-তে রূপান্তরিত হয়। শাকপাতায় ভিটামিন-সি এবং ফলিকএসিড থাকে, যা শস্যে এবং ডালে কম থাকে। তাই শাকসবজি ডাল ভাতের পরিপূরক।
মিষ্টিআলু এক প্রকার সবজি বিশেষ। একে বলা হয় ‘গরিবের খাদ্য’। কয়েকটি দেশে চাল এবং গমের পরিবর্তে মিষ্টিআলু ব্যবহার হচ্ছে। মূল জাতীয় শস্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তি উৎপন্ন করে মিষ্টি আলু। প্রতি ১০০ গ্রাম মিষ্টিআলুতে শর্করার পরিমাণ ২৮.২ গ্রাম। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আমিষ ১.২ গ্রাম, চর্বি ০.৩ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২০ মিলিগ্রাম, লৌহ ০.৮ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ৫৬৫ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.০৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ২ মিলিগ্রাম এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে ১২০ কিলোক্যালরি। সাদা ও লাল দুই বর্ণের এ আলু সাধারণত সিদ্ধ, ভর্তা, আগুনে পুড়ে এবং মাছ-গোশতের সাথে রান্ন করে খাওয়া যায়। ইচ্ছে করলে কাঁচাও খেতে পারেন। মিষ্টিআলু নিয়ে হালুয়া, চিপস, পায়েশ এবং আটার সংমিশ্রণে এর গুঁড়া দিয়ে তৈরি হয় বিস্কুট, রুটি, পাউরুটি, পেস্ট্রি, হরেক রকম পিঠা, কেক এসব মুখরোচক খাবার। প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা যায় শিশুদের বিকল্প খাদ্য। এর আছে আরও গুণ। গ্লুকোজ, চিনি, সিরাপ, স্টার্চ, পেপটিন এবং এ্যালকোহলের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে মিষ্টিআলু। এর কচিপাতা ও ডগা খুব পুষ্টিকর।
অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি প্রতি বেলায় আমাদের শাকসবজি খাওয়া আবশ্যক। কারণ শিশুদের অপুষ্টিজনিত রাতকানা, অন্ধত্ব, রিকেট, বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগ, স্কার্ভি, মুখ ও ঠোঁটের কোণে ঘা, রক্তশূন্যতা দূরীকরণে শাকসবজি কার্যকর ভূমিকা রাখে। আর এ জন্য শাকসবজি হতে হবে অবশ্যই বিষক্রিয়ামুক্ত। এ বিষয়ে কৃষকদের যতটুকু আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন, তেমনি দরকার সবজি বিক্রেতাদেরও। তাই আসুন, এ ব্যাপারে নিজে সচেতন হই; অপরকেও করি উৎসাহিত।