Business Talk

মাছে ভাতে বাঙালি

মাছে ভাতে বাঙালি  কথাটি প্রকৃত অর্থেই সঠিক, মাছ ও ভাতের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক বহুকালের। আদিকাল থেকেই মাছ খেতো বাঙালি। মাছের সঙ্গে ভাতের সম্পর্ক নিবিড় হওয়ার কারণটি হলো বাঙালির মুখ্য খাদ্য ভাত এবং দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় পছন্দের পদ মাছ। আরেকটি প্রধান কারণ হলো বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ, ধান ও মাছ দুইই সহজলভ্য।

হাজার বছরেরও পুরোনো বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’এই প্রবাদটি সেই হাজারো বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে। আগেকার দিনে যখন এত বিদেশি খাবারের প্রচলন ছিল না সে সময় বাঙালির সংস্কৃতি ছিল কিছুটা হলেও ভিন্ন। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির প্রধান খাদ্য ছিল ভাত। সে সময় এই গোটা উপমহাদেশে নদী-নালাও ছিল প্রচুর। প্রকৃতির দানে এদেশে নদী বিধৌত উর্বর ভূমিতে প্রচুর ফসল জন্মাত। বিশেষ করে ধান যেমন পাইজাম, নাজিরশাইল, কাটারিভোগ, বালাম, বিন্নি ইত্যাদি। অন্যদিকে নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় এদেশের সাগর, নদী, খাল-বিলে প্রচুর পরিমাণে মাছে জন্মে। এর মধ্যে রয়েছে রূপচাঁদা, কোরাল, লাক্ষ্যা, লইট্যা, ছুরি, ফাইস্যা, রুই, কাতল, মৃগেল, ভেটকি, চিতল, বোয়াল, শোল, কৈ, শিং, মাগুরসহ আরও নানা জাতের মাছ। কাজেই তারা ধান চাষ করে ও মাছ ধরে জীবিকা উপার্জনের পথ বেছে নেয়। এ সহজলভ্য মাছ আর ভাত আমাদের প্রিয় খাবার, স্বল্প শ্রম ও ব্যয়ে অতি সহজে এগুলো পাওয়া যায় বলে জীবন ও জীবিকার জন্য এর ওপর নির্ভরশীলতা আমাদের অনেক বেশি। আর ভাতের সঙ্গে যদি ইলিশ মাছ ভাজা হয়, তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই। আর তাই আমাদের মাছে-ভাতে বাঙালি বলা হয়। যুগ সন্ধিক্ষণের কবি, ঈশ্বরচন্দ্র বাঙালির সারসত্য এভাবে প্রকাশ করেছেন

‘ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল

ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।’

একসময় এ দেশে গোলা ভরা ধান ছিল, গোয়াল ভরা গরু ছিল, পাতিল ভড়া মাছ ছিল, ঢাকা-মসলিন কাপড় ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে মাছে-ভাতে বাঙালি’ কথাটি রূপকথার গল্প। কিছুদিন আগে ও কৃষকের অবস্থা এমন ছিল যে, নুন আনতে পানতা ফুরায়। সেই নদীর দেশ আর পুকুরভরা মাছের দেশ বাংলাদেশ এখন প্রায় খাল-বিল-নদী-নালা শূন্য। খাল-বিল ভরাট করে চলছে নানা স্থাপনা তৈরির মহোৎসব। সুতরাং খাল-বিল না থাকলে মাছ থাকবে কোত্থেকে? আর যেসব নদী অবশিষ্ট রয়েছে, সেগুলোতে দূষণের মাত্রা এত বেশি যে মাছের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন। আরও কিছু কারণ এই মিঠাপানির মাছ বিলুপ্তির পেছনে কাজ করে। যেমন: কৃষিজমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এই কীটনাশক বৃষ্টির পানি বা সেচের মাধ্যমে বিল, জলাশয়গুলোতে গিয়ে পড়ে এবং মাছের বেঁচে থাকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণে আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় মাছগুলো। মৎস্য ও পানিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক সংসদে জানান যে দেশে ৫৪ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ প্রায় বিলুপ্ত, ২৮ প্রজাতির মাছ চরম বিপন্ন এবং ১৪ প্রজাতির মাছ সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে।

বর্তমানে মৎস্যচাষিরাও এমন প্রজাতির মাছ চাষ করছেন, যেগুলো অতি অল্প সময়ে দ্রুত বর্ধনশীল। বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক শুধু সেইসব মাছ চাষের কারণে এবং উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশি মাছ চাষ করার ব্যাপারে অনীহার কারণেও আমরা হারিয়ে ফেলছি দেশীয় নানা মাছ। চাষের এসব মাছে কোনো স্বাদ নেই। অথচ ছোট-বড় নানা দেশি মাছের স্বাদ সে তো অমৃত।

যদিও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন অনেকাংশেই স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমও হয়ে উঠেছে মাছ চাষ। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মাছ উৎপাদনকারী দেশ। আশা করা হচ্ছে, অচিরেই এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছানো সম্ভব হবে। তাই নতুন প্রজন্মকে গৌরবময় এই ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে হলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন: হারানো নদী পুনরুদ্ধার, নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, নদীদূষণ রোধ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, মৎস্যচাষিদের দেশীয় মাছ চাষের ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করলে হয়তো বা সম্পূর্ণ বিলুপ্তির পথ থেকে বাঁচাতে পারবে এসব দেশি মাছ। বাঙালি আবারও স্বাদ নিতে পারবে নানা দেশি মাছের। দেশের নদ-নদী সংস্কারের যে কর্মসূচি সরকার গ্রহণ করেছে, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে বিশ্বের সর্বোচ্চ মাছ উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হওয়াও সহজতর হবে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *