চিনি আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সচারচর এই উপাদানটি আমরা আমাদের মুখরোচক খাবার তৈরীতে বা সকাল বিকালের খাবার তৈরীত ব্যবহার করে থাকি। চিনি একটি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাবার।চিনি উচ্চ সরল শর্করা ও উচ্চ ক্যালরিযুক্ত হওয়ায় রক্তে শর্করার পাশাপাশি শরীরের ওজন বাড়িয়ে দেয়।স্বাস্থ্য সচেতনতার চিকিৎসক-পুষ্টিবিজ্ঞানীরা সাদা চিনি বা চিনিকে খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে বলেছেন। এমনকি যারা ডায়েট করেন, তাদেরও খাদ্যতালিকা থেকে চিনি বাদ দিতে বলা হয়।বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য চিনি খাওয়া তো নিষেধই। প্রাকৃতিক এনার্জি বুস্টার হিসেবে মধু আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। চিনির বিকল্প হিসেবে মধুর কোনো জুড়ি নেই।
অতিরিক্ত চিনি রক্তে ও যকৃতে চর্বি বা ট্রাইগিস্নাসারাইড হিসেবে জমা হতে থাকে। ফ্যাটি লিভার, হৃদ্রোগসহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ায় চিনি।ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ সম্পন্ন মানবদেহের জন্যে এটি খুবই ক্ষতিকারক। তাই বলে যে মিষ্টি খাবার খাবেন না তা কিন্তু নয়।প্রকৃতিপক্ষে চিনি থেকে দূরে থাকা এটাও অনেকের জন্য কঠিন ব্যপার।বিশেষ করে যারা মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করেন। নানা কারণে চিনি খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছেন অনেকে। এক্ষেত্রে মিষ্টির অভাব পূরণে চিনির বিকল্প হিসেবে আপনি খেতে পারেন কিছু প্রাকৃতিক খাবার, যেগুলো চিনির থেকেও মিষ্টি। এগুলোতে নানা ধরনের পুষ্টিগুণও আছে। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক চিনির বিকল্প হিসেবে কোন কোন প্রাকৃতিক খাবারগুলো খাবেন-
মধু
প্রাকৃতিক এনার্জি বুস্টার হিসেবে মধু আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। চিনির বিকল্প হিসেবে মধুর কোনো জুড়ি নেই।এটা শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।মধুতে আছে প্রোটিন,ভিটামিন, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম আর পটাশিয়াম। প্রতিটিরই অনেক গুণ আছে৷এক চা চামচ মধুতে মাত্র ২০ ক্যালরি থাকে।পুষ্টিগুণের দিক থেকেও এটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য৷ তাই চিনির বিকল্প হিসেবে আপনার চা, কফিতে চিনি না মিশিয়ে সামান্য মধু মিশিয়ে খেতে পারেন।এটি ওজন কমাতেও সাহায্য করবে।
খেজুর
মিষ্টির অভাব পুরণে ব্যবহার করতে পারেন খেজুরও।খেজুর অত্যন্ত সুস্বাদু ও বেশ পরিচিত একটি ফল, যা খুবই স্বাস্থ্যকর।এটি ফ্রুকটোজ এবং গ্লাইসেমিক সমৃদ্ধ। এটা রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ায়। খেজুর ফলকে চিনির বিকল্প হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। খেজুর শক্তির একটি ভালো উৎস। তাই খেজুর খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের ক্লান্তিভাব দূর হয়।খেজুরে পটাশিয়াম, কপার, আইরন, ম্যাগনেসিয়াম এবং ভিটামিন বি ৬ থাকে। ভিটামিন বি৬ যা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। খেজুর চিনির চাইতেও মিষ্টি স্বাদের হয়। রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে খেজুরের জুড়ি নেই।খেজুরকে শুকিয়ে গুড়ো করে অথবা সিরাপ তৈরি করে যেকোনো খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
আখের রস
আখের রস প্রকৃতির আশ্চর্য দান। আখের রস প্রাকৃতিকভাবে মিষ্টি হওয়ায়, ডায়াবেটিস রোগীরা এটি এড়িয়ে চলেন। তবে জানেন কি আখের রসও কিন্তু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে, আখের রসে থাকে আইসোম্যাল্টোজ নামক একটি উপাদান। যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ করে নেমে গেলে আখের রস খেলে উপকার মিলবে। হাইপোগ্লাইসিমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর জন্যও এই রস উপকারী। তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে আখের রস খাবেন না। এই পানীয়টি শরীরে দারুণভাবে শক্তি যোগায়। তাছাড়া এটি ত্বকের টোনার হিসেবে, পরিপাকক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে এবং নানা ধরনের রোগ সারাতে সাহায্য করে। কিন্তু অন্যসব পানীয় পান করলেও আমরা প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় আখের রস রাখি না। রাস্তাঘাটে যেসব আখের রস পাওয়া যায় সেগুলো স্বাস্থ্যসম্মত না হওয়াও এর একটি কারণ।
গুড়
আখের থেকে উৎপাদিত চিনির পর আরেকটি গুরুত্বপুর্ন উপাদান হলো গুড়।চিনির চেয়ে গুড় অনেকাংশেই কম প্রসেসড৷গুড় এই উপমহাদেশের মানুষের অধিক পছন্দের একটি উপাদান।নতুন গুড়ের মিষ্টি খাওয়াও অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।চিনির রসে ডোবানো ভাজা মিষ্টির চেয়ে গুড়ের সন্দেশ বা রসগোল্লা নিশ্চিতভাবেই অনেক ভালো অপশন৷ গুড় থেকে তৈরি বাদামি চিনিও খেতে পারেন ৷ গবেষনায় দেখা গেছে চা অথবা কফির সাথে এক টুকরো গুড় আপনার স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারি এবং এটি আপনার রক্ত সঞ্চালনকে স্বাভাবিক রাখে।
কাঁঠাল
বর্তমানে কাঁঠাল সারাবছরই পাওয়া যায়। চিনির বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন খাবারে কাঁঠালের কোষ ব্যবহার করা যায়। কাঁঠালের বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাবারও প্রস্তুত করা যায়। যেগুলোতে চিনির বদলে কাঁঠালের কোষ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
কলা
কলা একটি প্রাকৃতিক খাবার। কলা চিনির মতই মিষ্টি জাতীয় একটি ফল। অনেকেই দুধ ভাত আর চিনি মাখিয়ে খেতে পছন্দ করেন। সেক্ষেত্রে চিনির বিকল্প হিসেবে কলা যোগ করা যেতে পারে।
স্টেভিয়া
এখন বাজারে চিনির বিকল্প বেশ কিছু খাবার পাওয়া যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে তুলনামূলক নিরাপদ স্টেভিয়ানির্ভর খাবারগুলো। এই স্টেভিয়া মূলত এক ধরনের ভেষজ পাতা। এই গাছের আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ে। স্বাদে ভীষণ মিষ্টি। সম্প্রতি বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে এর চাষ। বাজারেও পাওয়া যাচ্ছে স্টেভিয়ানির্ভর চিনির বিকল্প খাবার। গবেষণায় দেখা গেছে, এর অনেকগুলো পাতা একসঙ্গে নিলে এটি খেতে চিনির চাইতেও মিষ্টি লাগে। এটি দাঁতের ক্ষয়রোগ রোধ করে। স্কিন কেয়ার হিসেবে কাজ করে, তাই ত্বকের কোমলতা এবং লাবণ্য বৃদ্ধি করে। স্বাদ বৃদ্ধিকারক হিসেবেও স্টেভিয়ার অনেক চাহিদা রয়েছে। চা, কফি, মিষ্টি, দই, বেকারি ফুড, আইসক্রিম, কোমল পানীয়সহ এ জাতীয় নানা খাদ্যপণ্য তৈরিতে স্টেভিয়া ব্যবহার করা যায়। এর ভেষজ উপাদান মানুষের দেহে কোনো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না।
বাদাম
আমন্ড, কাজু, আখরোটের মতো বাদামের পাশাপাশি মিষ্টি কুমড়া, তিসি ইত্যাদির বীজ রাখুন প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়৷ এগুলোর প্রভাবে আপনার পেট বেশিক্ষণ ভরে থাকবে৷ বাড়তি চিনির প্রয়োজন হবে না।
আঙুর/স্ট্রবের
মিষ্টির পরিবর্তে খেতে পারেন বেরিজাতীয় ফল। যেমন আঙুর, ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি, রাস্পবেরি ইত্যাদি।
তাজা ফল
বেদানা, আপেল, আঙুর, কিশমিশ, কলার মতো ফলগুলো এমনিতেই মিষ্টি৷ খুব মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছে করলে ফল খেতে পারেন৷ গোটা ফল চিবিয়ে খাওয়ার ফলে প্রয়োজনীয় ফাইবারটাও আপনার শরীরে ঢুকবে৷
নারিকেল
চিনির বিকল্প হিসেবে ধরা হয় নারিকেলকেও। এটিও বেশ স্বাস্থ্যকর একটি খাবার। যদিও আপনি এটিকে চা কিংবা কফিতে ব্যবহার করতে পারবেন না তবে অন্যান্য মিষ্টি খাবারের সঙ্গে এটি অনায়সেই ব্যবহার করা যায়।
কোকোনাট সুগার
নারিকেল গাছের ফুলের কুঁড়ি থেকে কোকোনাট সুগার তৈরি করা হয়। এটি চিনির বিকল্প হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। কোকোনাট সুগারে ফ্রুক্টোজের পরিমাণ কম এবং এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্সও কম। এটি খাবার তৈরিতেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
ফলের রস
খাবারের সাথে মিষ্টান্ন হিসেবে ফলের জুস খেতে পারেন। যেটি চিনি ব্যবহার করে তৈরি করা যেকোনো খাবারের চেয়ে অধিক স্বাস্থ্যকর বলে জানান স্বাস্থ্যবিদরা। একগ্লাস ফলের জুসে যে পরিমাণ খনিজ ও ভিটামিন থাকে তা স্বাস্থ্যর জন্য খুবই উপকারি।
ডিটক্স ওয়াটার বা ফ্লেভারড ওয়াটার
অনেকে মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসেন এবং সারা দিনের যখন-তখন মিষ্টি কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হয়, তাদের জন্য আদর্শ ডিটক্স ওয়াটার বা ফ্লেভারড ওয়াটার৷ এক বোতল পানিতে মিশিয়ে নিন আপনার পছন্দের ফল৷ স্ট্রবেরি, আঙুর, আপেল, তরমুজ, পুদিনা, লেবু যা খুশি মেশাতে পারেন৷ এক রাত ফ্রিজে রাখুন৷ পরদিন পানিটা ছেঁকে পান করুন৷ সারাদিনে অল্প অল্প করে চুমুক দিয়ে খেলে আপনার মিষ্টি খাওয়ার তীব্র ইচ্ছে নিশ্চিতভাবেই কমে যাবে।
ফলের জ্যাম
চিনির বিকল্প হিসেবে খেতে পারেন ফলের জ্যাম। মিষ্টি স্বাদের ফল দিয়ে বানানো জ্যাম শরীরের জন্য উপকারী। জাম, আপেল, নাশপাতি, আঙ্গুর দিয়ে বানানো জ্যাম চিনির পরিবর্তে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন
জাইলিটল
জাইলিটল খেতে মিষ্টি হলেও এটি চিনি নয়। বিকল্প চিনি তৈরিতে জাইলিটল বা এ জাতীয় রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়। এতে চিনি প্রায় নেই বললেই চলে, ক্যালরিও খুব কম। ইরাইথ্রিটলও এ ধরনেরই একটি রাসায়নিক, যাতে ক্যালরি জিরো এবং চিনিও নয়, কিন্তু স্বাদে মিষ্টি। যারা মিষ্টি ছাড়তেই পারছেন না, তারা এগুলো দিয়ে মিষ্টান্ন দ্রব্য তৈরি করে মাঝেমধ্যে খেতে পারেন
বাদামী চিনি
বাদামী চিনি যদিও চিনি কিন্তু এটা সাদা চিনির মত ক্ষতিকর না, সে হিসাবে এটাকে সাদা চিনির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করার কথা বলতে পারি এই আর্টিকেলে। কারন আমরা মূলত এখানে চিনির বিকল্প হিসেবে, কি ব্যবহার করতে পারি তাই নিয়ে কথা বলছি।তো বাদামী চিনিকে ইংরেজিতে বলা হয় ব্রাউন সুগার। আর আঞ্চলিকভাবে এটিকে আমরা সবাই লাল চিনি হিসেবেই চিনি। এটিও স্বাদের দিক দিয়ে সাদা চিনির চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এই উপাদানটিতে রয়েছে ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও আয়রন। এ চিনিও সাদা চিনির মতো যে কোন খাবারের সাথে ব্যাবহার করা যায়।তবে ডায়বেটিস রোগীরা এটা অবশ্যই এভয়েড করবেন।