Business Talk

গরিবের আমিষ ডাল সেই ডাল নিয়ে কিছু কথা

ডাল (Pulse) শিম গোত্রের অন্তর্গত খাদ্যশস্য। ডাল প্রধানত বিউলি, মুগ, মসুর, ছোলা, মটর, অড়হর, মাষকলাই, খেসারি প্রভৃতি শুঁটিজাতীয় মৌসুমি ফসলের শুকনো বীজ। সব রকমের ডাল মানুষের জন্য অন্ত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও উপকারী। ডল হচ্ছে প্রোটিন প্রধান খাদ্য। ডালে যথেষ্ট পরিমাণে প্রোটিন ও ভালো পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট থাকে। অন্যান্য উদ্ভিজ্জ খাদ্যের চেয়ে ডালে প্রোটিন অনেক বেশি পরিমাণে থাকে যা প্রায় ২০-২৮ শতাংশ। এতে গমের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ও চালের তুলনায় তিন গুন প্রোটিন আছে। প্রোটিন ছাড়াও এতে থাকে শর্করা, চর্বি, খনিজ লবণ, ভিটামিন। দেখা গেছে যে, মাংস ও মসুর ডালের পুষ্টিমূল্য প্রায় সমান সমান। এজন্য ডাল জাতীয় খাদ্যের প্রোটিনের প্রাচুর্য ও দামে সস্তা হওয়ায় ডালকে প্রায়শই গরিবের আমিষ বা  গরিবের মাংস(poor man’s meat)বলা হয়।

এই ডাল একটি সাধারণ এবং অতি পরিচিত পদ বাঙালির খাদ্য তালিকায়। খাওয়ার শেষ পাতে ডাল না হলে হয়তো অনেকেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারেন না। বাংলাদেশে নিম্ন আয়ের পরিবারের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বেশি। মাংসের দাম বেশি হওয়ায় প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় তা রাখা সম্ভব হয়ে উঠে না। অপরদিকে সহজলভ্য ও দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় যে কোনো শ্রেণীর পরিবার এটি খাদ্য তালিকায় সংযুক্ত করতে পারেন। তাই আমাদের দেশে প্রোটিনের উৎস হিসেবে ডাল মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক একটা একটা করে কোন কোন ডালের কি কি উপকার।

বিভিন্ন প্রকারের ডাল এর পুষ্টি উপকারিতাঃ

আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রকারের ডাল উৎপাদন হয়।

মুগ,মসুর,ছোলা,মটর,অড়হর,মাসকলাই,খেসারি,বিউলি ইত্যাদি।এদের প্রত্যেকের পুষ্টি উপাদান ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে থাকে। এবার আমরা জানবো কোন ডালে কি পরিমাণ পুষ্টি উপাদান আছে এবং এদের উপকারিতা।

মাসকলাই ডালঃ

এটি স্বাদে যেমন মজাদার তেমন পুষ্টিতেও ভরপুর। একে বলা হয় প্রাকৃতিক পেট পরিষ্কারক কারণ এই ডালে রয়েছে প্রচুর ফাইবার।

উপকারিতাঃ

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং হজমে সহায়তা করে।

রক্তের সোডিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।

এতে বিদ্যমান ম্যাগনেসিয়াম রক্তে প্রবাহ স্বাভাবিক রাখে।

শরীরে কোলস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে হৃদ্‌যন্ত্র ভালো রাখতে সাহায্য করে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখতে পারে মাষকলাই ডাল।

পেশি গঠনে ও শরীর বর্ধনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

স্নায়ুবিক রোগ  যেমন  স্নায়বিক দুর্বলতা, স্মৃতি দুর্বলতা, সিজোফ্রেনিয়ার, হিস্টিরিয়ার মতো সমস্যা দূর করে।

 রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও ব্যাথানাশক হিসাবে কাজ করে।

ত্বকের মৃত কোষ সরিয়ে উজ্জ্বলতা বাড়ায়।রোদে পোড়া ত্বকের ক্ষেত্রেও এই ডাল উপকারী। এতে আছে প্রাকৃতিক জীবাণুনাশক ক্ষমতা। তাই মুখের ব্রণ দূর করতে পারে এটি। মুখের দাগ দূর করতেও মাষকলাইয়ের ডালের ব্যবহার দেখা যায়। এই ডাল মাথায় মাখলে চুল নরম হয়, খুশকি দূর হয়।

ছোলার ডালঃ

এটি অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টি গুণে ভরপুর। এটি বিদেশে পুষ্টির শক্তিশালী উৎস হিসেবে খুব জনপ্রিয় একটি খাবার। ডাল, সালাদ, হালুয়া সব ধরনের মজার খাবার তৈরি করা যায় এটি দিয়ে।

লুচি আর ছোলার ডাল মানেই তো বাঙালীর স্বপ্নের কম্বিনেশন। ছোলার ডাল লুচি দিয়ে তো খান, কিন্তু জানেন কি ছোলার ডালের চমৎকার? ছোলার ডালে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ডায়েটারি ফাইবার তো থাকেই, তাছাড়া ফোলেট, আয়রন, ফসফরাসও থাকে।প্রতি ১০০ গ্রাম ছোলায় আমিষ আছে প্রায় ১৮ গ্রাম। কার্বোহাইড্রেট আছে প্রায় ৬৫ গ্রাম। আর ফ্যাট আছে প্রায় ৫ গ্রাম। ছোলায় আছে বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ লবণ। প্রতি ১০০ গ্রাম ছোলায় রয়েছে প্রায় ২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম। ভিটামিন ‘এ’ আছে প্রায় ১৯২ মাইক্রোগ্রাম। প্রচুর পরিমাণে আছে ভিটামিন বি-১ ও বি-২। আছে ম্যাগনেশিয়াম ও ফসফরাস।

ছোলার শর্করার গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের পরিমাণ কম, যা শরীরে প্রবেশ করলে অস্থির ভাব দূর হয়। ছোলা খাওয়ার পর বেশ অল্প সময়েই হজম হয়। এর শর্করা গ্লুকোজ হয়ে দ্রুত রক্তে চলে যায় না।

অতএব,ছোলা ডায়াবেটিকস রোগীর জন্য খুবই উপকারী খাবার। ছোলার ফ্যাটের বেশিরভাগই পলি আনস্যাচুয়েটেড ফ্যাট, যা শরীরের জন্য মোটেই ক্ষতিকর নয়। ছোলার আঁশ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। নিয়মিত ছোলা খেলে আর নিয়মমত পায়খানা হলে খাদ্যনালীতে ক্ষতিকর জীবাণু থাকতে পারে না। ফলে খাদ্যনালীর ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে না বলা যায়। তাছাড়া কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

এর আঁশ রক্তের চর্বি কমায়। ছোলা দীর্ঘক্ষণ ধরে শক্তির যোগান দেয় শরীরে। জানা গেছে, প্রতি ১০০ গ্রাম ছোলা থেকে প্রায় ৩৮০ ক্যালরি পাওয়া যায়। ছোলা রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়।মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে।আর অ্যানিমিয়ার ধাত থাকলেও ছোলার ডাল খান। দেখবেন সুস্থ থাকছেন।

খেসারির ডালঃ

সোনালি-হলুদ বর্ণের এই ডালটি বেশ সুস্বাদু ।বিভিন্ন রকম পদের সাথে খেসারির ডাল খাওয়া যায় তবে খেসারি ডালের পিঁয়াজু অনেক মজাদার হয়ে থাকে।

খেসারী ডালে বিভিন্ন ধরণের পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে এবং দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় এই ডাল যোগ করলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। এতে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম রয়েছে।  খেসারী ডালে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে।

উপকারিতাঃ

খেসারী ডালে বিদ্যমান পটাসিয়াম রক্তে সোডিয়ামের পরিমাণ কমিয়ে রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।

খেসারি ডাল গিঁটের ব্যাথায় কার্যকরি।

অরুচি ভাব দূর করে।

অড়হর বা তুর ডালের উপকারিতা

পশ্চিমবঙ্গের বাইরে আমাদের অতি পরিচিত অড়হর ডালকে কিন্তু তুর ডাল বলেই ডাকা হয়। অড়হর ডালে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন তো থাকেই। সেইসাথে থাকে আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড। যেমন মিথিওনিন, লাইসিন, ট্রিপটোফ্যান ইত্যাদি। তাছাড়া ভিটামিন এ, ভিটামিন বি, পটাসিয়াম, সোডিয়ামও থাকে। অড়হর ডাল খাওয়া উপকার তো বটেই। কিন্তু জানেন কি অড়হর ডালের পাতা নিয়ে আপনি যদি আপনার কোনো কাটা বা ক্ষতের জায়গায় লাগান, তাহলে ঘা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাব্রিদ্দ

ডাল এর অপকারিতাঃ

ডাল পুষ্টিতে ভরপুর হলেও এতে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত গুনাবলিও রয়েছে। মনে রাখতে হবে, কোন কিছুই অতিরিক্ত গ্রহণ করা ঠিক না অতিরিক্ত গ্রহণের ফলে স্বাস্থ্যের অবনতি হতে পারে।

অতিরিক্ত পরিমাণে মসুর ডাল খেলে কিডনির উপর অত্যাধিক চাপ সৃষ্টি হয় যার ফলে কিডনি স্টোনের সম্ভাবনা থাকে।

খেসারি ডালে এক প্রকার উপাদান থাকে যা ল্যাথেরিজম নামক রোগ সৃষ্টি করে তাই বহুদিন ধরে এই আমিষ ডাল না খাওয়াই ভালো। এই রোগের ফলে দেহের নিম্নাংস বিশেষ করে পা অবশ হয়ে পড়ে এবং পঙ্গুতা দেখা দেয়।

যাদের উচ্চ পরিমাণে ইউরিক এসিডের সমস্যা রয়েছে তাদের মসুর ডাল না খাওয়াই ভালো।

মসুর ডালে রয়েছে উচ্চ পরিমাণে ফাইবার ও প্রোটিন যা শরীরে অত্যাধিক প্রবেশে ক্ষতি হতে পারে তাই পরিমাণ অনুযায়ী গ্রহণ করা উচিৎ।

ডালের এসকল অপকারিতার জন্যে আমাদের শরীরের প্রোটিনের চাহিদা পূরণে সাবধানতা বজায় রেখে ডাল খাওয়া সর্বোপরি উত্তম।

উপরের আলোচনা থেকে বলা যায় ডাল আমাদের দেহের শক্তি সঞ্চয়, দেহ গঠন ও ক্ষয় পূরন এবং রোগ প্রতিরোধে ব্যাপক ভুমিকা পালন করে থাকে। বিভিন্ন ধরনের ডাল বিভিন্ন পদের সাথে মিশিয়ে রান্না করে খাওয়া হয়। তবে যেভাবেই খাওয়া হোক না কেন অনেক পুষ্টি গুণে সমৃদ্ধ এই ডালগুলোর স্বাদ ভিন্ন তাই খুব সহজেই খাদ্যে বৈচিত্র্যতা আনা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *